জলবায়ু পরিবতন ও বাংলাদেশের নারী

জলবায়ু পরিবতন ও বাংলাদেশের নারী

-শিমুল আহসান

যেকোনো দুর্যোগের আগে ও পরে পরিবারের নারীর ভূমিকাই থাকে মুখ্য। শিশুদের দেখাশোনা, খাবার সংরক্ষণ, জ্বালানি সংগ্রহ প্রভৃতি বিষয়ে নারীই ভূমিকা রাখেন। সমাজে নারীর এসব কাজের মূল্য অনেক সময়ই দেওয়া হয় না। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য হলো, এর আচরণ নির্দিষ্ট নয়। অর্থাৎ যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের আরও একটি অনিশ্চিত বৈশিষ্ট্য হলো স্বল্প সময়ে বেশি বৃষ্টিপাত হওয়া।

জাতিসংঘের বৈশ্বিক উষ্ণতাবিষয়ক আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) তথ্য অনুসারে সমুদ্রের পানি আগামী ১০০ বছরে ৮৮ সেন্টিমিটার বাড়বে বলা হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি তারা একে পুনর্মূল্যায়ন করে ৮৪ সেন্টিমিটার বাড়বে বলে জানিয়েছে। আশার কথা হলো, এ পরিমাণ বাড়লেও আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। কারণ, উপকূলজুড়ে বাংলাদেশের ভালো প্রস্তুতি আছে। আমরা ডুবে যাব না। কারণ, আমাদের ১৫ ফুট উঁচু বাঁধ আছে। তবে আমাদের ভাবতে হবে লবণাক্ততা ও জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা নিয়ে। এ দুটোর পরিমাণ বেড়ে যাওয়াটা বিপদের কারণ হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রথমেই উপকূল অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কারণ এ অঞ্চলে সবচেয়ে গরিব মানুষেরও বিশুদ্ধ খাবার পানি কিনে পান করতে হয়। দুর্যোগকালীন এ অঞ্চলে নারীদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয় বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি সংগ্রহ করা।

জলবায়ু পরিবর্তন এখনো  প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এটি কেবল শুরু হয়েছে। একে মোকাবিলা করতে হলে আমাদের প্রথমেই নির্দিষ্ট করণীয় সম্পর্কে জানতে হবে। আমাদের কী করতে হবে, সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ক্ষেত্রে নারীদের বাদ দিয়ে কিছুই করা যাবে না। নারীরা পরিবেশের মৌলিক সবকিছুর সঙ্গেই নিয়োজিত থাকেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য, অধিকারসহ প্রভৃতি জায়গা থেকে তাঁরাই বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয়। তারপরও এর প্রভাব শিশুদেরও ভোগ করতে হয়। তারা তাদের শৈশব হারায়। অনেক সময় মা–বাবাকেও হারাতে হয় তাদের।

দুর্যোগকালীন নারীর ভূমিকাই থাকে মুখ্য। তিনিই তাঁর সন্তানদের মুখে যেকোনো উপায়ে খাদ্য তুলে দেন। এ ছাড়া গৃহস্থালির সম্পদ রক্ষার বিষয়টিও নারীর দায়িত্বে থাকে। তাই নারীকে এসব বিষয়ে উন্নত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দুর্যোগকালীন সুপেয় পানি জোগাড় নারীকেই করতে হয়। দেখা যায়, পুরুষেরা বাড়ির বাইরে যান কাজের সন্ধানে। তাই নারীকেই পানি জোগাড় করতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নারীকেই বেশি বাধাগ্রস্ত করে।

আমাদের দেশে নারীরা এমনিতেই অনেক ধরনের বঞ্চনা ও শোষণের শিকার হন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সে ক্ষেত্রে তাঁদের সামনে বাড়তি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তাই নারীকে অনেক বেশি তথ্যসমৃদ্ধ করতে হবে, প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কারণ তাঁরা সচেতন হলে পরিবারের অন্যরা রক্ষা পাবে। দুর্যোগের সময় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত যে ঝুঁকি, নারীরা তা সফলভাবে মোকাবিলা করছেন। তাঁরা পরিবারের খাদ্যের জোগান দিচ্ছেন। যাঁরা অসুস্থ, তাদের স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন। তাঁরা তাঁদের খাদ্য ও গবাদিপশু রক্ষা করছেন।

এ সবকিছু এটা নির্দেশ করে না যে পুরুষ সদস্যরা আসলে কিছুই করছেন না, তাঁরা কাজের সন্ধানে বাইরে চলে যাচ্ছেন। সব সময় গৃহস্থালির কাজগুলো নারীই নিরন্তরভাবে করে যাচ্ছেন। দুর্যোগ সহনশীলতায় নারীকে নাজুক হিসেবে না দেখে তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতাকে দেখতে হবে। তাঁদের এ বিষয়টিতেই আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।

আমাদের একটি কঠোর শ্রম বিভাজন রয়েছে। অর্থাৎ, পানি আনা নারীর কাজ, পরিবারের খাদ্য জোগান দেওয়া নারীর কাজ ইত্যাদি। এগুলোকে আমরা ফলপ্রসূ কাজ বলি না। জলবায়ু সহনশীলতায় আমাদের গ্রামীণ নারীরা যে ভূমিকা পালন করেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যান।

এক লাখ মানুষ চিংড়ি মাছের পোনা ধরে, যেটা আইনত নিষিদ্ধ। তারা সাধারণত দুবার চিংড়ির পোনা ধরতে নামে। প্রথমবার ভোররাতে ভাটার সময় এবং দ্বিতীয়বার দিনের বেলায়। সব মিলিয়ে তারা ১০ ঘণ্টা পানির মধ্যে থাকে। এদের অধিকাংশই হলো নারী ও িশশু। এতে তাদের স্বাস্থ্যের অনেক ক্ষতি হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগে নারীরা বড় ভূমিকা রাখেন। কিন্তু আমরা বিষয়টি সম্পর্কে কতটুকু সচেতন? আমরা নারীকে শুধু গৃহস্থালির কাজ করতেই দেখি। কিন্তু দুর্যোগকালীন নারীরা যে ভূমিকা রাখেন, তা অনেক বেশি কার্যকর। যেমন নারীরা যে মুঠো চাল সংগ্রহ করে রাখেন, দুর্যোগের সময় এটি অনেক বেশি কাজে লাগে।

জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নারীরা একটি শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারেন। এই বিশ্বাস যেন রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় থাকে। পরিবেশের তারতম্যের কারণে কিশোরীদের মধ্যে একধরনের দুশ্চিন্তা কাজ করে। যেমন অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, অতিরিক্ত গরম, অনেক দিন ধরে একটানা গরম পড়া কিংবা গরমের সঙ্গে ঠান্ডা। এসবের ফলে তাঁদের স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা হয়। মেয়েদের পিরিয়ডকালীন জলবায়ু পরিবর্তন তাঁদের মধ্যে একধরনের চাপ সৃষ্টি করে। এটি তাঁর মনঃসংযোগ ও পড়ালেখার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটায়।

নারীর ঝুঁকির পাশাপাশি নারীকে পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলায় যত বেশি সংযুক্ত করা যাবে, আমরা তত বেশি লাভবান হব। কারণ, নারীরা ব্যক্তিগত ঝুঁকি এবং নাজুকতার মধ্যেও দুর্যোগকালীন তাঁর দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করে যান। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মূল প্রভাব পড়ে জীবন–জীবিকায় এবং আমাদের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ওপর। আমাদের গ্রামীণ সমাজ কৃষিভিত্তিক সমাজ। এতে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা ও উপার্জনের নিরাপত্তা সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়ে। এ দুটির নেতিবাচক প্রভাবে নারীই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। সে সময় তাঁর চাপ অনেক বেশি বেড়ে যায়।

দেশের প্রতিটি গ্রামের ধরন-প্রকৃতি আলাদা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধে সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। পাশাপাশি জলবায়ু সহনশীলতা বাড়াতে হলে কোথায় কোন সম্পদ আছে, নারীর জন্য কীভাবে এর ব্যবহার করা যায়, তা দেখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মধ্যে শিক্ষাও একটি গুরুত্বপূর্ণ। স্কুলগুলো একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এগুলো তখন সাইক্লোন শেল্টাররূপে ব্যবহৃত হয়। শিশুরা তাদের মৌলিক অধিকার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের যাওয়ার জন্য সচেতনতা সেভাবে আসেনি। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে কীভাবে আরও ব্যবহারবান্ধব করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে।

সুপেয় পানি নিশ্চিত করার পরেই জ্বালানির দিকটিতে দৃষ্টিপাত করা উচিত। দুর্যোগের সময় বেশি সংকটে পড়তে হয় নিরাপদ পানির। কলেরা, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন প্রকার অসুখ থেকে নিরাপদ থাকার উপায় হলো বিশুদ্ধ পানি। খাবার তৈরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্বালানির প্রয়োজন পড়ে। আর তা তখন দুষ্প্রাপ্য থাকে। তা ছাড়া এ সবকিছুই করতে হয় নারীকে।

আমাদের সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।